:: এম.আর মাহামুদ ::
হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হলে পুরনো স্মৃতি ও অনেক গল্প মনে পড়ে। অনুরূপ একটি পুরনো গল্প মনে পড়েছে, গল্পটি উপস্থাপন করতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে গল্পটি অনেকেরই জানা থাকলেও হয়তো অনেকে ভুলতে বসেছে। তাদের মধ্যে আমিও এদের একজন। “পুন: মুসিক ভব” (তুই আবার ইদুর হও)। এক সময় এক ঋষির আখাড়ায় একটি ইদুর থাকত, ইদুরটি কোন ভাবেই ঋষির পাশ ছেড়ে যেতনা।
একদিন ঋষি চিন্তা করলেন ইদুরটি হয়তো বিড়ালের ভয়ে ঋষির আখাড়া ছাড়ছেনা, তখন ঋষি ইদুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল তুই বিড়াল হও। ইদুরটি বিড়াল হওয়ার পরও ঋষির আখড়া ছাড়তে রাজি নয়। তখন ঋষি আবার চিন্তা করলেন হয়তো বিড়ালটি কুকুরের ভয়ে আখড়া ছাড়তে চাচ্ছেনা। তখন ঋষি বিড়ালটিকে কুকুর হওয়ার জন্য আশির্বাদ করলেন। সাথে সাথে বিড়াল কুকুর হয়ে গেল। তারপরও কুকুরটি ঋষির আখড়া ছাড়ছেনা তখন চিন্তা করলেন হয়তো কুকুরটি বাঘকে ভয় পাচ্ছে বলে আখড়া ছাড়ছেনা। তখন ঋষি কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে মন্ত্র পড়ে ফু দিয়ে বললেন তুই বাঘ হয়ে যা, সাথে সাথে কুকুরটি বাঘ হয়ে গেল।
কদিন ঋষির চার পাশে বাঘটি ঘুরাফেরা করার পর একদিন রাতের আধারে ঋষির উপর আক্রমণ করে বসলেন। তখন ঋষি তার ভুল বুঝতে পেরে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন আমি ভুল করেছি। ইদুরকে বিড়াল, বিড়ালকে কুকুর, কুকুরকে বাঘ বানাতে গিয়ে আজ আমার উপর হামলা হল। তখন ঋষি মনের দুঃখে মন্ত্র পড়ে বলে বসলেন “পুনঃ মুসিক ভব” (তুই আবার ইদুর হও)। তখন বাঘটি পুনরায় ইদুর হয়ে গেল।
গল্পটি কাল্পনিক হলেও বাস্তবতার সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে। দেশের জনগণের জানমাল রক্ষায় নিয়োজিত আইন শৃৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য শাসকদলের নেক নজরে পড়ার জন্য নানা অপকর্ম লিপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষতি করে যাচ্ছে। এতে ওইসব কর্মকর্তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও জনগণের চরম ক্ষতি হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েও হজম করতে হচ্ছে।
এভাবেই ওইসব বিতর্কিত কর্মকর্তারা দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ সম্প্রতি ঘটে যাওয়ার টেকনাফের বাহার ছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খান।
বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে সরবে-নিরবে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। ইতিমধ্যে এ ঘটনার নয়ক ক্রসফায়ারের নেশায় আসক্ত টেকনাফের সাবেক অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত ও এস.আই নন্দ লাল রক্ষিতসহ ৭জন কারাগারে আটক রয়েছে হত্যা মামলার আসামী হিসেবে।
ইয়াবা পাচার রোধ কল্পে অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ ২০১৮ সাল তেকে ৩১ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত কথিত বন্দুক যুদ্ধের নামে ১৬১জন বনি আদমকে হত্যা করেছে। হত্যার শিকার সকলেই যে ইয়াবা পাচারকারী, এমন কথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হলফ করে বলতে পারবেনা, আবার নিহতদের মধ্যে অনেকেই ইয়াবা পাচারের সাথে জড়িত তাও বলা যায়। কিন্তু তাদের আত্ম পক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা মানব অধিকার পদদলিত করারই সমান।
সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানবতা বিরুধী অপরাধের দায়ে একটি রাজনৈতিক দলের অনেককেই মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। তাও বিচারের মাধ্যমে। কিন্তু বন্দুক যুদ্ধের নামে কোন যুদ্ধাপরাধীকে হত্যা করা হয়নি। তাহলে শুধুমাত্র ইয়াবা পাচারকারীর তকমা দিয়ে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা কতটুকু যুক্তিসংগত তা দেশের আইন বিশেষজ্ঞরাই ভাল জানে। ১৬১ জন পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের হাতে প্রায় ২০০ শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে।
তবে দেশকে মাদক মুক্তি করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অনেক ক্ষেত্রে কঠোর ভুমিকা পালন করতে হয়েছে। যেসব ব্যক্তি ইয়াবা পাচারকারী হিসেবে ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে তারা অনেকেই কামলা শ্রেণীর ইয়াবা পাচারকারী। কিন্তু রাঘব বোয়ালেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধরা ছোয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।
সংবাদ মাধ্যমে দেখা গেছে সাইফুল নামে একজন ইয়াবা ডন পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে, কিন্তু তার চাইতে উচু মাপের ইয়াবা পাচারকারী (সুবিধভোগী) দিব্বি আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদকে হত্যার পর (হয়তো তিনি সেনাবাহিনীর একজন চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে) হত্যা মামলায় ১৬১ জনের ঘাতক টেকনাফ থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ, বাহার ছড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ লিয়াকত ও এস.আই নন্দ লালসহ ৭ জন কারাগারে গিয়েছে।হয়তো তদন্ত শেষে তাদের বিচার হবে, বিচারিক আদালতে।
টেকনাফ থানার এ ঘটনাটি নিয়ে পুরো পুলিশ বাহিনীকে দায়ী করার কোন যুক্তি নেই। কারণ, পুলিশ বাহিনীতে অনেক সৎ ও দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা আছে। এ কারণে প্রদীপ বাবুদের ঘটনার দায়, পুলিশ বাহিনী নেবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান বেনজির আহমদ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে পুলিশের গৌরবময় ভুমিকার কথা ভুলবার নয়। যা ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লিখা থাকবে। করোনা কালে পুলিশের মহানুভবতাও মানুষ দেখেছে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন থানায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিম মাসুদ হোসেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজারকে ইয়াবা মুক্ত করবে। কিন্তু মেজর সিনহা হত্যার পর এ ঘোষণা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা দেখারই বিষয়।
লেখক : এম আর মাহমুদ, দৈনিক সমকাল-চকরিয়া প্রতিনিধি
সভাপতি -চকরিয়া অনলাইন প্রেসক্লাব, চকরিয়া কক্সবাজার ।
পাঠকের মতামত: